IOT & Robotics Engineering

  




ইন্টারনেট অফ থিংসঃ বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পথে পৃথিবী

ছেলেবেলায় কাজী নজরুলের সে কবিতা নিশ্চয় পড়েছেন- “বিশ্ব জগত দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে”। কবির সে অবদমিত ইচ্ছা আজ অনেকটাই সত্যি হয়েছে আজকের পৃথিবীর অন্যতম আলোচিত বিষয় ‘ইন্টারনেট অফ থিংস (Internet of Things)’ কে ঘিরে যার সংক্ষিপ্ত রূপ ‘আইওটি (IOT)’
Cisco এর CEO জন চেম্বার্স যখন বলেছিল “ইন্টারনেটই সব কিছু”, তখন তাঁর কথা শুনে বিদ্রূপের হাঁসি হেসেছিল সবাই। অথচ আজ দেখা যাচ্ছে ১৭ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশী একটা বাজার তৈরি হয়েছে এই ইন্টারনেট কে ঘিরে। ধারণা করা হচ্ছে আগামী ১০ বছরের মধ্যে সম্পূর্ন বাজার দখল করে নিবে ইন্টারনেট। এই ধারণা থেকেই মূলত তৈরি হয়েছে Internet of Things (IoT)
কেমন হবে, যদি আপনার শোবার ঘরটি আপনার শরীরের তাপমাত্রাকে কেন্দ্র করে নিজের তাপমাত্রার পরিবর্তন করার মাধ্যমে ঘরের পরিবেশকে আরামদায়ক করে তোলে? যদি এমন হয় যে, আপনার গাড়ি আপনাকে বলে দিচ্ছে কোথায় ট্র্যাফিক জ্যাম রয়েছে এবং কোন রোড অনুসরণ করলে আপনি আপনার গন্তব্যে খুব দ্রুত নিরাপদে পৌঁছতে পারবেন! বেশ হবে না?
জানি, ভবিষ্যতের এসব প্রযুক্তির কথা কল্পনা করতে বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করছেন! এর মধ্যে অনেকেই বেশ অবিশ্বাসের সাথে ভাবছেন, লেখকের উপর সাই-ফাই ফিল্ম বেশ ভালোই প্রভাব বিস্তার করেছে, তাই অতি কল্পনা করছে! কিন্তু যাদের বর্তমান প্রযুক্তি নিয়ে একটু আধটু জানা-শোনা আছে, তারা ঠোঁটে সবজান্তার বাঁকা হাঁসি টেনে মনে মনে বলছে, “কী নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছেন বুঝে গেছি, মশাই।
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন! আজ কথা হবে ‘ইন্টারনেট অফ থিংস’ নামের এমন এক প্রযুক্তি নিয়ে, যা আপনার নিকট ভবিষ্যতকে আরো বেশি সহজ, সাবলীল এবং কার্যক্ষম করে তুলবে।
ইন্টারনেট অফ থিংস আসলে কি?
দাঁত ভাঙ্গা কঠিন কোন সংজ্ঞায় না গিয়ে সহজ ভাবে বুঝার চেষ্টা করি IoT জিনিসটা আসলে কি। যখন অনেক গুলো ডিভাইস একটা আরেকটার সাথে ইন্টারনেট দ্বারা যুক্ত থাকবে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেদের মধ্যে ডাটা আদান প্রদান করে নিদির্ষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত নিবে অথবা পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন করবে তখন সেই সিস্টেমটাকেই বলা হয় ইন্টারনেট অফ থিংস।
ইন্টারনেট অফ থিংস মূলত একটি কম্পিউটার কন্সেপ্ট যেখানে প্রত্যেকটি কম্পিউটারকে একসাথে যুক্ত রাখার ব্যাপারে কাজ করা হয় এবং নিত্যদিনের ব্যবহৃত সব ধরণের ফিজিক্যাল ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রাদিগুলোকে ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত রাখাকে বোঝায়। এটা মূলত এক ধরণের ভার্চুয়াল নেটওয়ার্ক যেখানে সব ধরণের ইলেকট্রনিক্স, সফটওয়্যার, সেন্সর, অ্যাকচুয়েটরস এবং নেটওয়ার্ক সুইচ ইলেকট্রনিক অথবা ভার্চুয়াল ক্যাবল দ্বারা যুক্ত থাকে ও বিশেষ প্রয়োজনে ডেটা আদান প্রদান করে থাকে।
স্বাভাবিক ভাবেই আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে সেই ডিভাইস গুলি আসলে কি হতে পারে! আসলে, সেই ডিভাইসগুলো হতে পারে আপনার বাসার টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, বাথরুমের কল, দরজার লক থেকে শুরু করে একটা শহরের ট্রাফিক সিগন্যাল, স্ট্রিটলাইট সিস্টেম, GPS ইত্যাদি। এক কথায় বলতে গেলে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত ডিভাইসকেই আইওটি এর আওতায় আনা সম্ভব!
আমাদের চারপাশে প্রতিদিনকার জীবনে আমরা যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করি – এসি, কফিমেকার, টেম্পয়ারেচার কন্ট্রোল, ফ্যান, টিভি, দরজার ইলেক্টিক লক, গাড়ির গ্যারেজের দরজা, গাড়ি ইত্যাদি সবই ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিজের মুঠো থেকে পৃথিবীর যেকোন জায়গায় বসে নিয়ন্ত্রণের এক উপায়কেই এই ‘ইন্টারনেট অফ থিংস বা আইওটি’ বলা হচ্ছে। অবশ্য, শুধু ঘরের মাঝেই এর ব্যাপ্তি নয়, আইওটির সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হতে পারে যেকোন ইন্ডাস্ট্রি। যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল ওয়াং তো তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন,যদি আইওটির ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় তবে আমাদের পোশাকশিল্পের আগুন সংক্রান্ত দুর্ঘটনা ৯০ ভাগ পর্যন্ত এড়ানো সম্ভব হবে
আইওটি নিয়ে কল্পনা রাজ্যে বিচরণঃ
সেই দিন হয়তো খুব বেশি দূরে নয় যেদিন IoT ইংলিশ মুভিতে দেখা কল্পনা রাজ্যে নাড়া দেওয়া অবাস্তবকেও বাস্তবে রূপ দিবে!..কে জানে হয়তোবা ছাড়িয়েও যাবে! ভাবুনতো, ভোর পাঁচটায় স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম ঘড়ি আপনাকে জাগিয়ে দিচ্ছে। তারপর আপনি সাওয়ার নিবেন কিন্তু হিটার পানি গরম করতে ৩০ মিনিট সময় নেয় কিন্তু কোনও এক জাদুবলে তা গরম হয়ে যাচ্ছে আপনি ঘুম থেকে উঠার আগেই। সেই জাদু বাথরুমে আপনার পছন্দমত গান শুনিয়ে দিবে এবং গোসল শেষ হবার সাথে সাথেই কফি বানিয়ে রাখবে অটোমেটেড কফি মেকার এর সাহায্যে। সেই অদৃশ্য জাদু শক্তি অফিসে যাওয়ার জন্য গাড়ি গেরাজের মধ্যে অটোমেটিক ভাবেই রেডি করে রাখবে যা কিনা গুগুল এর মাধ্যমে চলে থাকে। আপনার কাছে এরি মধ্যে নটিফিকেশন এসেছে রাস্তায় আজ প্রচুর জ্যাম ২০ মিনিটি আগে বের হতে হবে যদি কিনা অফিস ঠিক মত পৌছাতে চান এবং বসের ঝাড়ি খেতে না চান ।
এই যে আপনার দিনটি শুরু হল নানান ধরনের ডিভাইসের সাহায্য নিয়ে ঠিক এটিকেই বলে থাকে Internet of Things (IoT)। ভেবে বলুন তো জীবনকে এত সহজ করা বিজ্ঞানের এই আশীর্বাদকে ম্যাজিক কল্পনা করলে কি অতিরঞ্জিত হবে ?
যেভাবে কাজ করবে আইওটিঃ
প্রয়োজনীয় কিছু ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস,সফটওয়্যার এবং সেন্সর এর সমন্বয়ে একটি নেটওয়ার্কিং সিস্টেম তৈরির মাধ্যমে এই প্রযুক্তি মুলত কাজ করবে। সেন্সর এর কাজ হল মানুষ কিংবা যেকোনো বস্তুর গতিবিধি মনিটর করে প্রয়োজনীয় তথ্য দেয়া এবং সেটা প্রসেস করে একটি ডিভাইস থেকে আরেকটি ডিভাইস এ প্রেরণ করা। এভাবেই চলতে থাকে একটি আইওটি সিস্টেম। তবে আসল কথা হল নেটওয়ার্কিং প্রযুক্তির উন্নতির ফলে এই নতুন স্মার্ট ডিভাইসগুলা ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত হতে পারে।
সাধারণভাবে ‘ইন্টারনেট অফ থিংস’ হলো ঐ প্রযুক্তি, যা প্রতিটি ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইসকে ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত করবে। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, আপনার প্রয়োজনীয় ডিভাইসগুলো একটি নেটওয়ার্কে পারস্পরিক সংযুক্ত থাকবে এবং প্রয়োজনে ডিভাইসগুলো একে অপরের সাথে যোগাযোগ এবং তথ্য আদান প্রদান করতে পারবে। সেই ক্ষেত্রে পুরো সিস্টেমটিই সেন্সর যুক্ত মেশিন এবং সফটওয়্যার সমন্বয়ে তৈরি হবে, যেগুলো প্রয়োজন মোতাবেক নির্দিষ্ট কাজের জন্য নিজে নিজেই তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কাজে ব্যবহৃত মেশিনটি ব্যবহারকারীর উপর নির্ভর না হয়ে নিজে নিজেই কাজ সম্পাদন করতে পারবে। আর এখানেই ইন্টারনেট অফ থিংসের সার্থকতা।
মনে আছে সেই হৃদয় ছোঁয়া মার্কেটিং স্লোগান –“এমন অনেক কিছুই হবে যা কেউ ভাবেনি আগে”। সত্যি যেন তাই! আপনি ভাবতেই পারেন ফ্রিজকে ইন্টারনেটে যুক্ত করে লাভটা কী, ওর কি ফেইসবুক একাউন্ট হবে নাকী? তা হয়ত হবে না। তবে সুবিধাটা হল এই সমস্ত যন্ত্রপাতি এখন নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে স্মার্ট সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আপনি বাজার করতে গেছেন কিন্তু আপনি জানেন না আপনাকে কি নিতে হবে কারণ আপনি জানেন না আপনার ঘরে কি রয়েছে। কিন্তু আপনার ফ্রিজটি যদি IOT কানেকটেড থাকে তাহলে বাজার থেকেই আপনার ফ্রিজে কি কি রাখা আছে নির্দিষ্ট অ্যাপসের মাধ্যমে সেই তথ্য পেয়ে যাবেন। আর এই তথ্য আপনাকে সরবরাহ করবে ফ্রিজ নিজেই। ভাবা যায়!!!
চলুন আরও মজার কিছু উদাহরণ দেয়া যাক।
মজার এই স্বপ্নসম্ভার গুলি ভালোই লাগছে, তাই না? ধরুন আপনি খুব ভুলোমনা মানুষ। হঠাৎ কোন জরুরী কাজে বাইরে চলে এসেছেন। তখন মনে পড়লো আপনার রুম লক করতে ভুলে গেছেন। নো টেনশন, অনেক দূরে বসেই নির্দিষ্ট অ্যাপসের মাধ্যমে আপনার রুম লক করতে পারবেন। ভবিষ্যতে এই IoT এর ব্যবহার এত ব্যাপক হবে যে প্রায় সব ডিভাইসগুলোই IOT কানেক্টেড হয়ে যাবে। আগামী ২০২২ সালের মধ্যে আরো প্রায় ১ ট্রিলিয়ন সেন্সর ইন্টারনেট এর সাথে কানেকটেড হবে অর্থাৎ আইওটি আরো সম্প্রসারিত হবে।
আরো ছোট দুটি উদাহরণ দেওয়া যাক!
ধরুন, বিকেলে বাসায় মেহমান আসবে। কিন্তু জরুরি ভিত্তিতে বেশ রাত পর্যন্ত আপনাকে অফিসে থাকতে হবে। বাসায় এমন কেউ নেই যে আগত মেহমানদের জন্য দরজা খুলে দেবে। অফিস দূরে হওয়ায়, অল্প সময়ের জন্য এসে আত্মীয়দের বরণ এবং আপ্যায়ন করার সুযোগও আপনার নেই। অফিসের কাজে দূরদূরান্তে থাকার কারণে বিভিন্ন সময়ই এই সমস্যাটির সম্মুখীন হতে হয় আপনাকে। তার সমাধান হিসেবে আপনি আপনার স্মার্ট প্রযুক্তি নির্ভর বাড়িতে (SmartHome) নতুন প্রোগ্রাম ইনস্টল করলেন। এটি আগত মেহমানদের চেহারা এবং কণ্ঠস্বর চিহ্নিত করার পর দরজা খুলে দেবে এবং বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করা মেহমানদের শরীরের তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করে ঘরের পরিবেশকে আরো আরামদায়ক করে তুলবে! সাথে সাথে স্থানীয় আবহাওয়া বিশ্লেষণ করে আপনার কফি মেকারটি ঠাণ্ডা আবহাওয়ার জন্য গরম কফি এবং গরম আবহাওয়ার জন্য ঠাণ্ডা কফি মেহমানদের পরিবেশন করবে!
এবার ধরুন, আপনার বিশাল একটি গরুর খামার আছে। নির্দিষ্ট সময় পরপর সেখানে প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সেখানে পানির ব্যবস্থা করতে হয়। এর জন্য বিশাল লোকবল প্রয়োজন। প্রয়োজন এমন কয়েকজন কর্মচারীর, যারা সার্বক্ষণিক এর তত্ত্বাবধানে থাকবে। যদি খামার আয়তন বড় হয়, গরুর সংখ্যা বেশি থাকে, তাহলে কর্মচারীর সংখ্যাও বাড়াতে হবে। আর তার জন্য মাস শেষে গুনতে হবে বিশাল অংকের টাকা! কিন্তু এরপরেও সমস্যা রয়ে যায়। কর্মচারীদের দ্বারা নিয়মিত প্রায় পুরো খামার জুড়ে সঠিক সময়ে খাবার এবং পানি দেওয়া হয়ে ওঠে না। এমনকি পরিমাণে কম, কখনো বেশিও হয়ে যায়। ফলাফল হিসেবে দেখা যায়, নির্দিষ্ট সময় পর আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। অথবা খরচের পরিমাণ হিসেবের চাইতে বেশি হয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তিবিদ এক বন্ধুর সাথে সমস্যাটি নিয়ে কথা বলতেই সে আপনাকে পুরো সিস্টেমটিকে অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসতে বলল, যেটি নির্দিষ্ট সময় পরপর গামলার খাবার এবং পানির পরিমাণ বিশ্লেষণ করে পুনরায় খাবার, পানি দিবে। আপনি চাইলে প্রত্যেকটা গরুর জন্য প্রত্যাশা অনুযায়ী আলাদা আলাদা নির্দিষ্ট ডায়েটের ব্যবস্থাও করে দিতে পারেন এই সক্রিয় সিস্টেমের মাধ্যমে!!
যে কারণে ইন্টারনেট অফ থিংস প্রয়োজনঃ
‘ইন্টারনেট অফ থিংস’ ধারণাটি নিয়ে প্রথম আলোচনা করা হয় ১৯৮২ সালের দিকে। Carnegie Mellon University-এর কয়েকজন গবেষক মিলে প্রথম ইন্টারনেট কানেক্টেড কোক মেশিন তৈরি করেন, যেটি নতুন লোড করা কোকাকোলার তাপমাত্রা বিস্তারিত বলতে পারবে। কিন্তু ‘ইন্টারনেট অফ থিংস’ উল্লেখ করে এ ব্যাপারে প্রথম বক্তব্য রাখেন এমআইটির অটো-আইডি (Auto-ID) সেন্টারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী পরিচালক ক্যাভিন এশটন। মাল্টিন্যাশনাল প্রোডাক্ট ম্যানুফেকচার কোম্পানি Procter & Gamble এ দেওয়া ঐ বক্তব্যে ইন্টারনেট অফ থিংস এর সম্ভাব্য ক্ষেত্র নিয়ে তিনি আলোচনা করেন।
তিনি বলেছিলেন- “বর্তমানে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট পুরোপুরি মানুষের দেওয়া তথ্যের উপর নির্ভরশীল। ৫০ পেটাবাইটের (১ পেটাবাইট = ১০২৪ টেরাবাইট) মতো ডাটা ইন্টারনেটে সংগৃহীত রয়েছে যার প্রায় পুরোটাই কেউ না কেউ লিখে, রেকর্ড করে, ডিজিটাল ফটোগ্রাফের মাধ্যমে, নয়তো বারকোড স্ক্যান করে স্টোর করেছে। তবে সমস্যা হচ্ছে মানুষ সীমিত সময়, অল্প মনোযোগ এবং খুব কম যথাযথতা নিয়ে জীবন ধারণ করে। অর্থাৎ তারা দুনিয়ার সব ধরণের ডাটা সঠিকভাবে স্টোর করতে পারে না। কিন্তু যদি কাজটি কোনো কম্পিউটারকে দেওয়া হয় এবং শিখিয়ে দেওয়া হয়, কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিকটি বাছাই করা যায়, তাহলে বাছাইকৃত তথ্যগুলো মানুষ খুব সহজেই ব্যবহার করতে পারবে এবং সাথে সাথে অপব্যয়, খরচ এবং ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারবে (খেয়াল করে দেখুন, উপরে উদাহরণ হিসেবে দেওয়া গরুর খামারের যে গল্পটি ছিল তার সাথে বেশ মিলে যায়)। আমরা তখন নির্ভুলভাবে জানতে পারবো কোন জিনিসটিকে পরিবর্তন, পরিমার্জন এবং প্রতিস্থাপন করতে হবে।”
কেভিন এশটন ‘ইন্টারনেট অফ থিংস’ সম্পর্কে উপরোক্ত ভবিষ্যদ্বাণীটি করেছিলেন আরো আঠারো বছর আগে। বর্তমানে ইন্টারনেটের এই দুনিয়ায় আরো পরিবর্তন এসেছে। ৫০ পেটাবাইট ডাটার সাথে যোগ হয়েছে আরো হাজার হাজার পেটাবাইট ডাটা। শুধুমাত্র মাইক্রোসফট, গুগল, আমাজন এবং ফেসবুকের ডাটার পরিমাণই ১২০০০ পেটাবাইট এর বেশী এবং এই সংখ্যাটা প্রতিনিয়ত বাড়ছেই..। তাহলে ভাবুন একবার, কী পরিমাণ ডাটা রয়েছে ইন্টারনেট জুড়ে! আর এর থেকে নির্ভুল ডাটা উদ্ধার করে যদি ব্যক্তিগত বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাজে ব্যবহার করতে পারি তাহলে কী পরিমাণ কার্যক্ষম এবং সহজ হয়ে উঠবে আমাদের পৃথিবী। কিন্তু আপনি আমি চাইলেই এই ডাটা উদ্ধার করতে পারবো না। এর জন্য অবশ্যই প্রয়োজন স্বয়ংক্রিয় মাধ্যম। কেভিন এশটনের মতে যা ছিল একটি শিখিয়ে পড়িয়ে দেওয়া কম্পিউটার যার ব্যবস্থা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে নির্ভুল ডাটা সনাক্ত করে বিভিন্ন প্রয়োজনে আমরা ডাটাগুলোকে ব্যবহার করতে পারছি।
এখন বর্তমান টেকনোলজির দিকে একবার তাকান। দিন দিন ফিজিক্যাল ডিভাইসের পরিমাণ বাড়ছে। কম্পিউটারের আদি যুগ সেই কবেই চলে গেছে। বর্তমানে কম্পিউটার একটি আধুনিক ওয়ারেবল ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। চারপাশে অসংখ্য স্মার্টফোন, অপারেটিং সিস্টেম সম্বলিত ঘড়ি, ব্রেসলেটের ছড়াছড়ি। গাড়ি, বাড়ি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকুইপমেন্টগুলোও অটোমেশনের আওতায় চলে যাচ্ছে। এমনকি পছন্দের কুকুরের ডগ ট্যাগটাও কম্পিউটারাইজড। আপনি চাইলে কুকুরটি কোথায় আছে, আশেপাশের পরিবেশ দেখতে কেমন- তা সবই ঘরে বসে আপনার স্মার্টফোনের স্ক্রীনে দেখতে পারবেন। কিন্তু এখানে সমস্যা হচ্ছে, প্রত্যেকটি ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইসকে দিয়ে কাজ করানোর জন্য আপনার প্রয়োজন তাকে প্রত্যেকটা একক কাজের জন্য আলাদা আলাদা নির্দেশ দেওয়া, যা বেশ সময় সাপেক্ষ এবং টেকনিক্যাল কাজ। আর এ সমস্যাটি সমাধান করেছে ‘ইন্টারনেট অফ থিংস’।
এখানে নেটওয়ার্কে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংযুক্ত ডিভাইসগুলো ইন্টারনেটের বিভিন্ন স্টোরেজে থাকা ডাটা, ব্যবহারকারীর ইনপুট দেওয়া ডাটা এবং নিজের সংগ্রহ করা ডাটাগুলোকে একে অপরের সাথে শেয়ার করবে। এই ডাটাগুলোর মধ্য থেকে প্রয়োজনীয় ডাটা নির্দিষ্ট কাজের জন্য ব্যবহার করবে এবং স্টোর করে রাখবে যাতে অন্য কোনো অবস্থায়, অন্য কোনো কাজে ডাটাগুলোকে ব্যবহার করতে পারে।
পুরো বিষয়টি বিবেচনা করলে দেখা যায়, ‘ইন্টারনেট অফ থিংস’ একটি প্রযুক্তি বিপ্লব, যা কঠিন কঠিন কাজগুলো খুব সহজেই করে দিবে। পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে অপব্যয় এবং খরচ কমিয়ে আনবে। প্রচুর পরিমাণে সময় বাঁচিয়ে দিবে। জনশক্তিকে অন্যান্য সেক্টরে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীকে আরো সুন্দর বাসভূমি হিসেবে আমরা গড়ে তুলতে পারবো।
ইন্টারনেট অফ থিংস এর ভবিষ্যৎঃ
প্রযুক্তিবিদরা ইন্টারনেট অফ থিংসকে ‘The Next Industrial Revolution’ আখ্যা দিয়েছে। পৃথিবীব্যাপী এই প্রযুক্তি নিয়ে ইতোমধ্যে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোও ২০২৫ সালের মধ্যে হতে যাওয়া সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও বলে ফেলেছে। আসুন সেসব সম্ভাব্য ভবিষ্যতের দিকে চোখ বুলানো যাক।
  • ২০২৫ সালের মধ্যে পৃথিবী জুড়ে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডিভাইস ইন্টারনেটের সাথে সম্পৃক্ত হবে। যার মধ্যে ৩০ বিলিয়ন ডিভাইস আইওটি প্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত থাকবে। এ সময়ের মধ্যে এই খাতের উন্নয়ন, সমস্যা সমাধান সহ বিভিন্ন কাজে ব্যয় হবে প্রায় ছয় ট্রিলিয়ন ডলার!
  • প্রায় সব ধরনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আইওটির দিকে ঝুঁকবে। এর মূল কারণ হবে তিনটি- ১) ইন্ডাস্ট্রিগুলোর পরিচালনার কাজে যা খরচ হতো, তা কমে যাওয়া, ২) কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়া এবং ৩) নতুন পণ্য উৎপাদন।
  • সরকার হবে এই প্রযুক্তির দ্বিতীয় বৃহত্তর গ্রহীতা।
যত দিন যাবে ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইসের প্রতি মানুষজন আরো বেশি ঝুঁকবে। প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদনের সংখ্যাও বেড়ে যাবে। ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর দাম কমে যাওয়া প্রায় প্রত্যেকের কাছে ইন্টারনেট কানেক্টেড স্মার্ট ডিভাইস থাকবে। পুরো পৃথিবীটা একটি ট্রুলি গ্লোবাল-ভিলেজে রূপান্তরিত হবে। এখন শুধু মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে, অদূর ভবিষ্যতে যখন আমাদের নিত্য-ব্যবহার্য জিনিসপত্র গুলোও ইন্টারনেট ব্যবহার করে একে অপরের সাথে যোহাযোগ করতে শুরু করবে তখন সেটার প্রভাব ঠিক কতখানি ব্যাপক হবে তা আসলে অনুমান করা একপ্রকার অসম্ভব! কারন, যখন ইন্টারনেট প্রথম শুরু হয়েছিলো তখন কারোর পক্ষেই ধারনা করা সম্ভব ছিলোনা ইন্টারনেট পৃথিবীকে ঠিক কতদূর নিয়ে যাবে! ..আজ আমাদের প্র্যাতহিক জীবনের এমন কিছু খুঁজে পাওয়া কঠিন যেটাতে ইন্টারনেটের সম্পৃক্ততা নেই! ইন্টারনেট আমাদের নতুন দিগন্ত দিয়েছে, নতুন পৃথিবী-নতুন ভাবনা-নতুন জীবনধারণ এর সাথে মানুষকে গেঁথেছে। আর এই ইন্টারনেটেরই পরবর্তি বিকাশ- 'ইন্টারনেট অফ থিংস' আরও কি অসাধ্য সাধন করবে,আরও কি কি দিগন্ত উন্মোচন করবে সেটা কি আগে ধারণা করা আদৌ সম্ভব!?
আইওটিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনাঃ
বিশ্বব্যাপী আইওটি এখন একটি বড় ও সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি। বাংলাদেশেও এই প্রযুক্তির ব্যাপক সম্ভাবনা ও ক্ষেত্র রয়েছে। আসলে আইওটি এমন একটা প্রযুক্তি যেটাকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। এর ক্ষেত্র কত বিস্তৃত হতে পারে সে সম্পর্কে পুরোপুরি ধারনা দেওয়া বেশ মুশকিল বা বলা ভালো অসম্ভব একটি কাজ! কারন কৃষিক্ষেত্র,শিক্ষাক্ষেত্র,চিকিৎসাক্ষেত্র থেকে শুরু করে ব্যবসা-বানিজ্য,কল-কারখানা,দৈনন্দিন জীবন সকল ক্ষেত্রে এর ব্যাপক প্রায়োগিক দিক রয়েছে।
তাই বাংলাদেশের সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এর গুরুত্ব অনুধাবন করে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেছে। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে আইওটির বিভিন্ন প্রকল্পসহ মিরপুরে আইওটি ল্যাব নির্মাণের জন্য অনুদান দিয়েছে। সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ডাটা-সফট বাংলাদেশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আইওটি নিয়ে বড় ধরনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে।সুইডেনের নেটওয়ার্ক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান এরিকসন বাংলাদেশের জন্য ‘ইন্টারনেট অব থিংস’ নামের একটি পোর্টাল চালু করেছে। এছাড়াও সরকারী উদ্যোগে বিভিন্নক্ষেত্রে আইওটির প্রয়োগ করা হচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে এর ব্যপক চাহিদা ও সম্ভাবনার কথা ভেবে এবং দক্ষ জনশক্তি গঠনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আইওটি বিষয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স চালু করেছে ।
অতএব, পুরো বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও যে আইওটি বিপ্লব খুব তাড়াতাড়ি সংগঠিত হবে এ প্রত্যাশা করা যেতেই পারে!
[N.B] আইওটিতে কি ধরনের ক্যারিয়ার অপুরচুনিটি থাকছে এবং আইওটির কোর্স-কারিকুলাম সম্পর্কে আরো দুটি বিস্তারিত আর্টিকেল শীঘ্রই প্রকাশ করা হবে.

No comments

Powered by Blogger.
Youtube Channel Image
ABS EMON Subscribe To watch more video Tutorials
Subscribe